বার্তাকক্ষ
দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মায়ানমারের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুসম্পর্ক বিরজমান। মিয়ানমার সীমান্তেও এতদিন ভারতের কোনো ধরনের সীমান্ত সুরক্ষা দেয়াল তৈরির প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এমনকি মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী নাগরিকদের জন্য ভারতের অভ্যন্তরে সীমানা থেকে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ভিসামুক্ত চলাচলেরও সুবিধা দিয়েছে দেশটি।
যদিও এখন মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তকে অবাধ রাখার এ নীতি থেকে সরে আসছে নয়াদিল্লি। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত ২০ জানুয়ারি ঘোষণা দিয়েছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে ১ হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার সীমান্তকে কাঁটাতার দিয়ে সুরক্ষিত করার কথা ভাবছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকার এখন মিয়ানমার সীমান্তে অবাধ চলাচলের নীতি পুনরায় নিরীক্ষা করে দেখছে। এ অবাধ চলাচলের সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে।’
এদিকে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি রুপিতে বাস্তবায়নাধীন কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের লক্ষ্য হলো মিয়ানমারের সিত্তে বন্দরকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করা। একই সঙ্গে কলকাতার সঙ্গে ভারতের মিজোরামের দূরত্বও অনেক কমিয়ে আনবে প্রকল্পটি। ব্লুপ্রিন্ট অনুযায়ী, এটি বাস্তবায়ন হলে কলকাতা থেকে রাখাইনের সিত্তে বন্দরে পাঠানো পণ্য কালাদান নদী হয়ে খালাস হবে চিনের পালেতওয়া বন্দরে। এরপর সেখান থেকে তা সড়কপথে পরিবাহিত হবে মিজোরামে। সেক্ষেত্রে শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেনস নেকের ওপর ভারতের নির্ভরতাও অনেকখানি কমে আসবে। এছাড়া প্রকল্পটি প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়াসগুলোকেও লাভবান করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে শঙ্কা ঘিরে ধরেছে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মি। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর বক্তব্য অনুযায়ী, চিন-রাখাইনে মিয়ানমারের জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি ও সংগঠনটির মিত্রদের সাম্প্রতিক সামরিক সাফল্য ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সীমান্ত বন্ধের আলোচনাটিকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
আরাকান আর্মির ক্রমাগত সামরিক সাফল্য এরই মধ্যে ভারতীয় অনেক পর্যবেক্ষককে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সংগঠনটি ভারতের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
গত অক্টোবরের শুরু থেকে অপারেশন ১০২৭-এর আওতায় আরাকান আর্মি ও এর মিত্র সংগঠনগুলো বাংলাদেশ, চীন ও থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের শহরগুলো একের পর এক দখল করে নিয়েছে। লড়াই ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠায় এসব শহর থেকে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী উদ্বাস্তুর সংখ্যাও গত কয়েক মাসে বেড়েছে। নতুন এ উদ্বাস্তুদের মধ্যে যেমন সীমান্তবর্তী শহরের স্থানীয় বাসিন্দা রয়েছে, তেমনি রয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পরাজিত সেনারাও।
স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য থেকে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আরাকান আর্মির সৈন্য সংখ্যা এখন ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। সংগঠনটি গড়ে তোলা হয়েছিল কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মির সহায়তা ও প্রশিক্ষণে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারে প্রকাশিত এক নিবন্ধের ভাষ্যমতে, নিজ সীমান্ত এলাকায় কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি এবং এর সহায়তা ও প্রশিক্ষণে গড়ে তোলা সংগঠন আরাকান আর্মির ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠা ও একের পর এক শহর দখল করে নেয়ার বিষয়টি ভারতের জন্য মোটেও সুখবর নয়। গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সশস্ত্র সংগঠনগুলোর বড় একটি অংশকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি।
বর্মি পর্যবেক্ষক কিয়াও সান হ্লাইংয়ের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি আরো জানিয়েছে, মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর মধ্যে আরাকান আর্মি তুলনামূলক নবীন। এর পরও সংগঠনটি দ্রুত সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে আরো কারণ আছে। আরাকান আর্মি মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর ফেডেরাল পলিটিক্যাল নেগোসিয়েশন অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশন কমিটির অন্যতম সদস্য। এ কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছে এখন ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউএসএ)। সংগঠনটিকে ধরা হয় মিয়ানমারের বৃহত্তম ও সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী সংগঠন হিসেবে। জাতিগত বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর মধ্যে চীনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ইউডব্লিউএসএ এরই মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত ওয়া প্রদেশের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় পর্যবেক্ষকরা অভিযোগ তুলেছেন, ভারতের বিপক্ষে কৌশলগত সুবিধা পাওয়ার উদ্দেশ্য থেকে হয়তো চীন আরাকান আর্মিকে তহবিল দিয়ে সহায়তা করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি নিয়ে ভারতের উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে সংগঠনটির পালেতওয়া ও বন্দরনগরী সিত্তের নিকটবর্তী পাউকতাও দখলের খবর।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেদিন মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণের ঘোষণা দেন তার প্রায় সপ্তাহখানেক আগে বাংলাদেশ সীমান্তের ২০ কিলোমিটার দূরে চিন প্রদেশের পালেতওয়া পূর্ণ রূপে দখল করে নেয়ার কথা জানায় আরাকান আর্মি। সংগঠনটির রাখাইনের সিত্তের নিকটবর্তী পাউকতাওয়ে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আসে গত সপ্তাহে। পর্যবেক্ষকদের ভাষ্যমতে, ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট (পুবে চলো) নীতিমালায় পালেতওয়া ও সিত্তের অবস্থান কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এ দুই শহরকে কেন্দ্র করে ভারতের অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে উচ্চাভিলাষী কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট। আরাকান আর্মির উত্থান এখন প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ভারতকে।