হাসান মোরশেদ
কোন তর্কের সুচনা হলে মুল বিষয়কে আড়াল করে অন্যান্য বিষয়কে গুরুত্বপুর্ণ করে তোলে দুই শ্রেনীর মানুষ।।।
প্রথমতঃ মুর্খগণ যাদের বিষয় সংশ্লিষ্ট জ্ঞান নেই , দ্বিতীয়তঃ ধূর্তগণ যারা মুল বিষয়টিকে আড়াল করতে চায়। এই দুই শ্রেনীকে মাথায় রেখে কিছু ন্যারেটিভ বিষয়ে সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট কথা বলা যাক।
এক।
জিআই ট্যাগ বিষয়টি কী? এই ট্যাগ প্রদানের অথরিটি হচ্ছে World Intellectual Property Organization. তাদের সংজ্ঞামতে- A geographical indication (GI) is a sign used on products that have a specific geographical origin and possess qualities or a reputation that are due to that origin. সহজ সরল সংজ্ঞা। যে পণ্যের সুনির্দিষ্ট ভৌগলিক অরিজিন আছে এবং এই ভৌগলিক অরিজিনের কারনেই পণ্যটির সুনাম তৈরী হয়েছে- সেই পণ্য জিআই ট্যাগ অধিকারী হয়।
ইন্ডিয়া রাষ্ট্র ‘টাঙ্গাইল’ শাড়ির জিআই ট্যাগ দাবী করে পেয়ে গেছে এবং তাদের সংস্কৃতি মন্ত্রনালয় থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্ট করা হয়েছে- ” The Tangail Saree, Originating from West Bengal”
আলাপ ঠিক এখানেই- টাঙ্গাইল শাড়ি কি অরিজিনিটিং ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল? আপনি যদি মনে করেন হ্যাঁ- তাহলে ভারতের দাবী ঠিক আছে। আর আপনি যদি জানেন- না, টাঙ্গাইল শাড়ির অরিজিন বাংলাদেশের টাঙ্গাইল অঞ্চলে তাহলে আপনি স্পষ্টভাবে বলবেন ভারতের দাবী মিথ্যা।
টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই ট্যাগ তর্কে মুল কথা এটুকুই। এর বাইরে যা আলাপ- শাড়ি কারিগররা পশ্চিম বঙ্গে চলে গেছে নাকি বাংলাদেশের নারীরা শাড়ি পরা ছেড়ে দিয়েছে সেগুলো সবই হয় বোকা আলাপ না হয় ধুর্ত আলাপ।
দুই।
” ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীরা হিন্দু গণহত্যা চালিয়েছে”। এই আলাপের মুল উদ্দেশ্য যদি থাকে পাকিস্তানীরা মুসলমানদের বা অন্যদের হত্যা, নির্যাতন করেনি তাহলে সে আলাপ হয় বোকামী নয় ধুর্ততা। অবশ্যই পাকিস্তানীরা হিন্দুদের টার্গেট করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। পাশাপাশি মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাইকে হত্যা করেছে। হিন্দু হত্যাযজ্ঞ ছিলো টোটাল জেনোসাইডের একটা অংশ।
তৎকালীন জনসংখ্যার হিসাবে ১ কোটি ৫ লক্ষ হিন্দু জনগোষ্ঠির ৯০ লক্ষ ভারতে শরনার্থী হয়েছিলেন। দেশে থাকা ১৫ লক্ষের সবাই নিহত হননি। ৩০ লক্ষ শহীদের হিসাব মিলে কী করে?
ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম ও ডাঃ হাসানের গবেষনা বলছে- ধর্ষিতা নারীদের ৫৬% ছিলেন মুসলিম, বাকীরা হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। যৌক্তিক। কারন মুসলমানরা সংখ্যায় কম শরনার্থী হয়েছিলেন ফলে অবরুদ্ধ দেশে ধর্ষনের শিকার হয়েছেন বেশী। এছাড়া মুসলিম জনসংখ্যা ছিলো কয়েকগুন বেশী। সংখ্যাতাত্বিকভাবেও ক্ষতির শিকার হয়েছেন বেশী। সে কারনে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও বেশী। আক্রান্ত না হলে, নিরাপদ থাকলে এতো বেশী সংখ্যক মুসলমানদের মুক্তিযুদ্ধ করে প্রাণ দেয়ার দরকার কী ছিলো?
তিন।
“ভারত বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে”। না, ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক শক্তি ছিলো। দলিলপত্রে তাই লেখা আছে। এলাইড ফোর্স/ জয়েন্ট ফোর্স/ মিত্র বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতের রাজনৈতিক বা সামরিক নেতৃত্বের কেউ কখনো এমন উদ্ভট দাবী করেননি। এই দাবী করে এখনকার ‘কিছু ভারতীয়’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ফ্রান্স দখল করে নিলে জেনারেল শার্ল দ্যা গল ইংল্যান্ডে প্রবাসী সরকার গঠন করে যুদ্ধ করেছিলেন। সাহায্য করেছিলো বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এলাইড ফোর্স। বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্রের কেউ বলেনা- আমরা ফ্রান্স স্বাধীন করে দিয়েছি।
চার।
বাংলাদেশ সহ দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার সকলের সাংস্কৃতিক পরিচয় ভারতীয়। না। অখন্ড ভারত বলে ইতিহাসে স্থায়ী কিছু ছিলোনা কখনো। এমনকি বৃটিশ ভারতেও পাঁচশতাধিক প্রিন্সলি স্টেট ছিলো যারা ১৯৪৭ এর পর ভারত বা পাকিস্তানে যুক্ত হয়েছে। মোগল আমলেও অখন্ড ভারত ছিলোনা। মৌর্য যুগেও না। বহু স্বাধীন রাজ্য বিদ্যমান ছিলো নিজ নিজ স্বকীয়তা নিয়ে। ইতিহাসের পরিক্রমায় কখনো এরা কেউ কেউ একক শাসনাধীনে এসেছে, আবার আলাদা হয়েছে। সুলতানী আমলেও আলাদা “বাঙ্গালা সালতানাত” ছিলো। আরো আগে বঙ্গ নামে আলাদা রাজ্য ছিলো, প্রাচীন যুগে গঙ্গারিডির উল্লেখ আছে। মহাভারতে অন্য রাজাদের সাথে উল্লেখ আছে বাংলার রাজার যিনি তাঁর হস্তিবাহিনী নিয়ে কৌরবদের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন।
আজকের ভারত রাষ্ট্রের পাঞ্জাব, কর্ণাটক বা কেরালার সাথে বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতির কীসের মিল আছে যে এই দাবী মেনে নিতে হবে আমরাও ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ? আমাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি যা হাজার বছরের পরিক্রমায় আজকের রূপ গ্রহন করেছে। আমরা ঠিক ততোটা ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ হতে পারি যতোটা এশীয়, যতোটা বৈশ্বিক সংস্কৃতির অংশীদার আমরা। এর বাইরে যদি কোন আলাপ থাকে- সেটা হয় বোকামী নয় ধুর্ততা।
লেখক ও গবেষক